খুব সুখী মানুষ আমি। কেন? কারণ আমার ঘরে তিনটি মেয়ে সন্তান আছে। বিয়ে হয়েছিলো আমার প্রেম করেই। নাহ, প্রেমটা পরিবার মেনে নেয়নি। বাবাকে খুব ভয় পেতাম। আর মা……… ঘরের বড় সন্তান ছিলাম ঠিকই কিন্তু মা কেন যেন আমাকে পছন্দ করতেন না ছোট বেলা থেকেই। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন দেখতে, বাবাও কম ছিলেন না। কিন্তু স্রষ্টা আমাকে তাদের মত রুপের অধিকারী করে গড়ে তুলেননি। তবে আমি আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস করিনা। আমার গায়ের রং, ফেসের মাধুর্য সবটা নিয়েই আমি খুশি। আমার আরও তিনটা বোন আর একটা ভাই আছে। মানে আমরা দুই ভাই আর তিন বোন। সবার ক্ষেত্রে আদরটা ঠিকই ছিল মায়ের কিন্তু আমার বেলাতেই কেন যেন বাধা। মাকে বলতেও শুনেছি, তোর মুখটা দেখলে আমার খুবই অসহ্য লাগে, কিভাবে এমন কুৎসিত দেখতে ছেলে আমার ঘরে জন্মালো আমি বুঝেই উঠতে পারিনা। তবে যত যাই হোক, তারা আমার বাবা মা তো, তাই তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে কার্পণ্য করেননি।
আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন, খাইয়েছেন, পড়িয়েছেন সবই করেছেন। শুধু বুকে নিয়ে চুমু খেয়ে বলেনি যে, সোনা ছেলে আমার, আমার কলিজা, আমার সাত রাজার ধন। তবে এসব দেখেছি- আমার ছোট ভাইটাকে যখন এভাবে বলতো তখন। খুব ভালো লাগতো সেই দৃশ্য দেখতে। তবে খুব লোভ লাগতো এই স্বাদটা নেওয়ার। মাঝে মাঝে তো সেখানে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম হ্যাংলার মতো, আর মায়ের গাঁ ঘেঁষে নীরব আবদার করতাম। মুখে বলার সাহস যে মা আমাকে দেয়নি কখনই। আমি জানি না, মা আমার সেই নীরব হয়ে তার গাঁ আলতো ঘেঁষে যে আবদার করতাম সেটা বুঝতো কিনা। হয়তো বুঝতো হয়তো বুঝতো না। তবে আমি যেটা শুনেছি যে, মায়েরা নাকি তাদের বাচ্চাদের সব আকার ইঙ্গিতই বুঝতে পারে। ছোট ভাইটাকে আমিও খুব ভালোবাসি। সে দেখতেও হয়েছে মায়ের মতই অনেকটা। একেবারে ফর্সা, যেন মাখন দিয়ে তৈরি। চেহারাও মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর। তবে সে আমাকে অনেক ভালোবাসতো।
প্রেম হয়েছে একজনের সাথে। খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাকে। মেয়েটি দেখতে আমার মতো ছিল না। মানে দেখতে ভারি মিষ্টি ছিলো। দিনে দিনে বয়স আমার বাড়তে লাগলো, সাথে মেয়েটিরও। ওহ তোমাকে আর কতো দিন বলবো যে, বাসা থেকে খুব বিরক্ত করছে আমাকে, বিয়ে করা এখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কেন বাসায় প্রপোসাল পাঠাচ্ছো না? তুমি তো ভালো জব করছো, বাসার বড় ছেলে, তাহলে বিয়ে করতে কিসের বাধা? নাকি আমাকে বিয়ে করতে চাইছো না? তাহলে বলে দাও, শুধু শুধু আমাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার মানেটা কি? মালিহা, মেয়েটা যখন কথা বলে তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে।
মাঝে মাঝে তো খুব বকা খাই তার, কারণ আর কি, তাকে দেখতে যেয়ে সে কি কথা বলছে সেটাই শুনি না। ব্যাস, হয়ে গেলো তো, চরম বকুনি খাই তখন। কিন্তু এই মিষ্টি মেয়েটাকে কিভাবে বুঝাই যে, বাবা, মাকে বিয়ের কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমি বেড়ে উঠেছিই এভাবে। কিন্তু তোমাকে এটা বলাও যাবে না, কারণ তাতে করে আমার বাবা মায়ের প্রতি তোমার একটা খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে। উফ, আর তো ম্যানেজ করতে পারছি না একে, কি করবো? বাসায় কি বিয়ের কথা বলবো নিজের থেকেই?
সালেহ, ঘম থেকে উঠ জলদি। মায়ের ডাকে ধপ করেই ঘুম থেকে জেগে বসে পরলাম। ওহ, কয়টা বাজে? অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো নাকি? তা তো হয়েছেই, তবে আজ তুই অফিসে যাসনে, একটা কাজে আমাদের সাথে বাইরে যাবি। এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নে, আর শোন, সুন্দর ভাবে মুখটা পরিষ্কার করিস। যাতে করে মানুষের কথা না শুনতে হয়। এই বলেই মা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই বুঝলাম না, তবে বুঝতে পারলাম শুধু এটাই যে, আমার চেহারা নিয়ে মায়ের আফসোস। যাক, মায়ের কথা মত অফিসে গেলাম না, নিজেকে যতটা সম্ভব হয়েছে ধুয়ে মুছে নিয়েছি। মুখে মাখানো যত রকম প্রোডাক্ট আছে মোটামুটি সব দিয়েই ধুয়েছি। মা, বাবার সাথে যেতে হবে বলে কথা। ভাইয়া, তোমাকে দেখতে তো একেবারে সালমান খানের মতো লাগছে। ব্যাপারটা কি? বউ দেখতে যাবে তাই এতো সাজগোজ তাই না? বলেই হাহা করে হেসে উঠলো সাজিদ। কিহ?? বউ দেখতে মানে? এসব কি বলছিস সাজিদ? কেন, তুমি বুঝি জানো না? মা তোমাকে কিছুই বলেনি? না রে সাজিদ, তুই আমাকে সব বলতো, কোথায় যেতে হবে আজ আমাকে? ভাইয়া, তোমার বিয়ের কথা চলছে। মেয়ে নাকি খুব সুন্দরী। ওরা তোমার সম্পর্কে সব শুনে তো মেয়েকে দেওয়ার জন্য এক পায়ে রাজি।
এখন তোমাকে দেখে যদি পছন্দ করে তাহলেই কেল্লা ফতে। বউ আসবে ঘরে, আমরা ভাবী পেয়ে যাবো আর তুমি পাবে বউ। সাজিদের মুখে এসব শুনে আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। আমি এসব কি শুনছি? কিরে রেডি হয়েছিস? হ্যা মা। তাহলে জলদি চল। গাড়িতে বসে অনেকবার মায়ের দিকে তাকালাম, মালিহার কথা এখনই যে আমাকে বলতে হবে।
আর নয়তো………। কিন্তু কিছুতেই সাহস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমি যদি মালিহার কথাটা বলি, তাহলে কি মা আমাকে ত্যাজ্য করবে? বাবা কি আমাকে মারবে? ছোট বেলা থেকে বাবার হাতে অনেক মার খেয়েছি। দোষ করলেও মার খেতাম, দোষ না করলেও মার খেতাম। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়ি তখন বাবার হাতে মার খেয়েছিলাম, এর পর আর বাবা আমাকে মারেনি। হয়তো তার মনে হয়েছে ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে।
হাহাহাহা……… । কিন্তু ভয়টা এখনও কাজ করে আমার মধ্যে। অনেক চেষ্টা করলাম মা’কে মালিহার কথা বলতে। নাহ, সম্ভব হলো না আমাকে দিয়ে। তার মানে কি, মালিহাকে ঠকাতে হবে? কি সব ভাবছি আমি, আরে আমার চেহারা দেখেই তো পাত্রী পক্ষ বিয়েতে না করে দেবে। সেই সুযোগেই মা’কে মালিহার কথাটা জানাবো। গেলাম এক বাসায়, ওমা, এরা তো বিয়ের কথা সব ফাইনাল করেই বসে আছে। মা সব আগেই ঠিক করে রেখেছে। আমাকে জাস্ট শো হিসেবেই নিয়ে গেছে। এমনকি মেয়েকেও দেখা করালো না আমার সাথে। মায়ের হয়তো ধারণা যে, মেয়ে আমার সাথে কথা বললে বিয়েতে রাজি হবে না। আর তাই এই ব্যবস্থা। খুব কষ্ট লাগছিলো, আবার হাসিও পাচ্ছিলো। যত যাই হোক, মা তো, তাই ছেলের বিয়ে যাতে ভেঙে না যায় সেটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হুম, সবার সাথে ছেলের নামে খুব সুনামও করছেন। আমার ছেলের মতো ছেলে হয়না, যেমনি ব্রিলিয়ান্ট তেমনি ভদ্র।
বড় চাকরী করে, অনেক ধার্মিক, আরও কতো কি। মায়ের মুখে আমার সুনাম এই প্রথম শুনলাম। আমি জানি না এসব মা মন থেকে বলছেন নাকি শুধুমাত্র আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যই। কেন যেন কান্না চলে আসলো, মায়ের মুখে প্রশংসা। আহ, কি যে মধুর লাগছে। সেকি, আমার বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়ে গেলো। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। আরে, আমি মালিহাকে কি জবাব দিবো? আর আমি কি করে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করবো? না, না, আমি যে মানতে পারছি না। একই মালিহা কল দিচ্ছে কেন? হ্যা মালিহা বলো। কই তুমি? এইতো মায়ের সাথে আছি।
সালেহ আমাকে মাফ করে দিও। আমি আর আমার পরিবারের সাথে যুদ্ধ করতে পারলাম না। আমি জানি না তুমি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাওনি, হয়তো তুমি অন্য কাউকে চাও। তবে যাকেই চাও না কেন, তুমি সুখী হও দোয়া করি। আর আমাকে পারলে মাফ করে দিও। আমাকে আর খুঁজো না প্লিজ। এটা বলেই ফোনটা কেটে দিলো মালিহা। আমাকে কিছু বলার সময়টাও দিলো না। যাক বাবা, ফোনটা বন্ধ করে দিলো? কিন্তু আমি তো মালিহাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। খুব কষ্ট হচ্ছিলো, খুব কান্না পাচ্ছিলো। কিন্তু আমার এই কান্নার, এই কষ্টের কোন মূল্যই যে আমার পরিবারের কাছে নেই। আমরা বাসায় ফিরলাম। যে করেই হোক, মালিহার সাথে যোগাযোগ করতেই হবে।
দরকার হলে আমি ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। কিন্তু বাবা মা? না, না, এতো ভয় করলে কেন প্রেম করেছিলাম? আমি তো একটা মেয়েকে এভাবে ঠকাতে পারিনা। মালিহার বান্ধবী জেবাকে কল দিলাম। জেবা আমি সালেহ বলছিলাম, মালিহার খবর জানো কিছু? ভাইয়া ওর তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর আপনাকে বলতে বলেছে যেন ওর বিয়েতে আপনি কোন ঝামেলা না করেন। জেবার কথা শুনে খুব ভেঙে পরলাম। এদিকে আমার বিয়ের জন্য খুব আয়োজন হচ্ছে। এই প্রথম দেখছি, মা আমার কোন ব্যাপারে এতো খুশি, আর এতো আয়োজন করছে শুধু আমার জন্যই।
খুব ধুমধাম করেই বিয়ে হয়ে গেলো আমার। বসার ঘরে এক প্রকার জোর করেই সবাই পাঠালো। খাটের উপর একটা মেয়ে বউ সেজে বসে আছে আমার অপেক্ষায়। কিন্তু আমি তো মালিহাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আর এই মেয়েকে আমি কিভাবে ঠকাবো? না, না, তাকে বলতেই হবে সব। আমি তাকে নয়, আরেকজনকে ভালোবাসি। শুধু শুধু তার জীবনটা আমি নষ্ট করতে পারবো না।